অনাহারী কুকুরের জন্য কাঁদে তাদের মন

কোথাও কেউ নেই। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় এক নাটকের নাম। ঢাকা শহরের সঙ্গে নাটকের নামটি এখন খুব যাচ্ছে। এই শহরের এমন ছবি দেখেনি কেউ আগে। সত্যিই কোথাও কেউ নেই। অজগর সাপের মতো লম্বা হয়ে আছে পথগুলো। কোথায় তার শুরু, কোথায় শেষ কেউ জানে না।

শহরের দোকানপাটেও শক্ত তালা আঁটা। খুলছে না কিছু। কিছু ওষুধ আর খাবারের দোকান ছাড়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজারের দোকানেরও একই অবস্থা। নিথর পথে কেউ বেরোচ্ছে না। বাড়িঘরের দুয়ারগুলোও বন্ধ। মানুষেরা ঘরে ঢুকে আছে। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া বারণ। কিন্তু এই শহরে মানুষ ছাড়াও তো অনেক প্রাণির বাস। কুকুর, বিড়াল, কাকসহ নানান পাখি। এদের কথা কি কারো মনে আছে? আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে যাদের জীবন বাঁচে, তারা এখন কী খাচ্ছে?

কেউ না কেউ তো ভাবছেনই অনাহারি এসব প্রাণিদের নিয়ে। এরা তো আর করোনা বোঝে না। ক্ষুধায় ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে। যদি কোথাও সামান্য খাবার মেলে! না পেলে একটা সময় শুয়ে পড়ছে পথের ধারে। পথের এসব কুকুরের ক্ষুধা নিবারণে কাজ করছে কিছু তরুণ। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে খাবার কিনছে। বিলিয়ে দিচ্ছে প্রাণিগুলোর মুখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান তেমন এক পশুপ্রেমী। গত কয়েকদিন ধরে খুঁজে খুঁজে অনাহারী কুকুরগুলোর মুখে তুলে দিচ্ছেন খাবার। তার সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন উদ্যোমী তরুণ। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় যেসব কুকুর রয়েছে তাদের ক্ষুধা নিবারণে কাজ করছেন।

মাহমুদুল হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সারাদিন না খেতে পারা জন্তুগুলোর মুখগুলো দেখে খুব কষ্ট হয়। সবচেয়ে কষ্ট হয় পানির জন্য তাদের তৃষ্ণা দেখে। পানির কল বন্ধ থাকায় ওই এরিয়ায় পানি পান করার কোনো উপায়ই নেই।’

তার সঙ্গে এই কাজে আছেন, তাওহিদ তানজিম, ওমর ফারুক তাওহীদ, আল আমীন, শাহরিয়ার রহমান, শোয়েব আদনান।

মাহমুদুল হাসান জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাকিম চত্বর, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন এলাকা, সমাজবিজ্ঞান চত্বর, কলাভবন এলাকা, শ্যাডো ক্যাফেটেরিয়ার সামনে, মল চত্বর, সূর্যসেন, মহসিন, এফআর, জহুরুল হক হলের কুকুরগুলোকে খাবার দিচ্ছেন তারা।

জানান, তাওহিদ তানজিম শুক্রবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে খাবার কিনে নিয়ে এসেছেন।

এছাড়া তারা কিছু বাছাইকৃত দিনমজুরদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার জিয়াউর রহমান, জসীমউদ্দীন , বঙ্গবন্ধু, একাত্তর, সূর্যসেন, মহসীন হলসহ এফবিএস, কলাভবন, আইবিএ, মধুর ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় মসজিদ, সমাজবিজ্ঞান চত্বর, হাকিম ও চারুকলার কুকুরদের খাবার বিতরণ করেন।

এনিয়ে ফেসবুকে লেখা দিনপঞ্জিতে মাহমুদুল হাসান লেখেন, ‘চারুকলার দরজাটা বন্ধ ছিলো। তাই গেট টপকিয়ে ঢুকতে হইছে। জসীমউদ্দিন হলের টাইগারটা দেখে একটু ভয় লাগছিলো প্রথমে। কিন্তু মধু আর আইবিএর কুকুরগুলোর সম্পর্ক যে এতো আক্রমণাত্মক, আগে জানতাম না।’

ওইদিন তারা কুকুরের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। রান্নাসহ সবকিছু ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আল আমীন। এছাড়া শাহরিয়ার রহমান ও শোয়েব আদনানও ছিলেন তাদের সঙ্গে।

বুধবার মুরগির পা, কলিজা আর মাথা খাবার হিসেবে কুকুরগুলোর মুখে তুলে দিয়েছেন তারা। বিস্কুট বা কেকজাতীয় খাবারে শক্তি কম, তাই প্রোটিন জাতীয় খাবারকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

এর আগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দোকান ঘুরে বিস্কুট, কেকের গুড়া কিনে অনাহারী প্রাণিগুলোর মুখে তুলে দিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবারের মা কুকুর ও তার বাচ্চাদের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন হাসান। লিখেছেন, ‘এক আপু সমাজবিজ্ঞান চত্বরের বাচ্চাসহ কুকুর মাকে শেল্টারে পাঠিয়েছেন। খাবারের অভাবে বাচ্চাগুলোও মায়ের দুধও পাচ্ছিল না! আজকে খাওয়াতে গিয়ে যা দেখলাম, ক্যাম্পাসের কলগুলো বন্ধ থাকায় পানি খেতে পারছিল না কুকুরগুলো। তাই টেপ খুলে আর মিস্টির প্যাকেট ও নারকেলের খোলে পানি দিয়েছিলাম কুকুরগুলোকে। আমরা নিজেরাও হয়তো কখনো অনুভব করিনি যে নিজের অজান্তেই কতগুলো প্রাণের খোঁড়াক জুগিয়ে এসেছি এতোদিন।’

সমাজে যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন মাহমুদুল হাসান। বলেছেন, ‘ছিন্নমূল মানুষের মতো এদেরও প্রাণ। এই দুর্যোগের সময় তাদের প্রতিও আমাদের দায়িত্ব আছে। সমাজের বিত্তবান, স্বচ্ছল ব্যক্তিরা যদি এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের কাজটি আরও সহজ হয়।’

S-(ঢাকাটাইমস/ ২৯ মার্চ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*